আব্দুর নুরঃ
সন্দ্বীপ আমাদের অনেক কাছের দ্বীপ। আমাদের সাহিত্যে সন্দ্বীপের বিশেষ উল্লেখ আমি পাইনি। অথচ বিদেশি ভ্রমণ-সাহিত্যে বার বার সন্দ্বীপের কথা এসেছে। সেই সূত্রে কয়েকবার সন্দ্বীপে যেতে চেয়েছি। হয়ে ওঠেনি। সাতশো বছর আগেই বাংলার জনপদের সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির সৃষ্টি হয়েছে। আবাদ হয়েছে। ফলন হয়েছে। সন্দ্বীপে অনেক বাঙালি মনীষীর জন্ম হয়েছে। শিক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার অগ্রসরে সন্দ্বীপের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
নবম শতাব্দীতে আরব বণিকরা বর্ণনা করেছিল সন্দ্বীপে প্রচলিত লবণ তৈরির প্রণালী সম্পর্কে। ওরা লিখেছিল পরে শুধু বাণিজ্যের খাতিরেই, লবণের জন্য, বাংলার শস্যের জন্য, বীজের জন্য, পর্তুগিজ আরমেনিয়ান ওলন্দাজ বণিকরা বাংলাদেশে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছে। সেই যুগে ওদের রণবাহিনীর একটি বড় ক্ষেত্র হলো সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপে ওরা আখড়া রাখতো। খ্রিস্টীয় ১৫৬৭ সালে পর্যটক সিসেরেফেডারসি সন্দ্বীপ দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। সন্দ্বীপের কৃষিকাজ, ফলফলাদির আবাদ, ফসলের প্রাচুর্য ও সবুজের সমারোহ দেখে ফেডারসি মন্তব্য করেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর দেশের অন্যতম হলো সন্দ্বীপ।’ তিনি বলেছিলেন সন্দ্বীপের জমিতে যে বীজই বপন করা হোক না কেন সে বীজে ফলন হবে বিপুল-প্রচুর। সন্দ্বীপের সমাজ নিয়ে খুব বেশি লেখা না-হলেও কিছু কিছু মন্তব্য ছিল। দ্বীপের অধিকাংশ মানুষই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। ইসলামের সত্য আদর্শে নিষ্ঠ হয়ে নামাজ পড়ত প্রতি প্রহরে। এমন কি তাদের মুসলমান রাজাও। ফেডারসির লেখার মধ্যে আমি সন্দ্বীপের রাজার নাম খুঁজে পাইনি। আমার সীমিত গবেষণায় বাংলার কোনো ইতিহাসবিদের লেখায় সন্দ্বীপের রাজার নাম পাইনি। এখনো খুঁজছি।
প্রায় চল্লিশ বছর পর অন্য এক বিদেশি পর্যটকের লেখায় আমরা সন্দ্বীপ সম্পর্কে জানতে পারি। ১৫৯৯ সালে পাদ্রি ফ্রান্সিস ফার্নান্দেজ খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে গোয়া থেকে বাংলাদেশে আসেন। জাহাজে বাংলায় প্রবেশের পথে পড়ে সন্দ্বীপ। ফার্নান্দেজ সন্দ্বীপ হয়ে, চট্টগ্রাম বন্দর ঘুরে, মেঘনা নদী ধরে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আসেন। ফার্নান্দেজের কথায়—বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সুখী, তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট। ওদের প্রায় বেশির ভাগই মুসলমান। সকলেই আল্লাহর উপর তীব্র বিশ্বাস রেখেছে। চাঁদপুরে মেঘনার অববাহিকায় ফলমূলের ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তৃপ্ত। পাদ্রি যাচাই করে দেখেছেন বিশ্বাসী বাংলার মানুষকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর করা সহজে সম্ভব হবে না। শুধু সন্দ্বীপে নয়, পাদ্রি ফ্রান্সিস যাচাই করে দেখেছেন মেঘনার চারপাশে বসবাসকারী হিন্দু ও বৌদ্ধ বাঙালিদেরও খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তর করা সহজে সম্ভব হবে না। ফলে মনোরথে পাদ্রি ফার্নান্দেজ ধর্মযাজকতার বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্যিক পেশায় নিয়োজিত হন। অবশেষে নিজের দেশ পর্তুগালে ফিরে যায়।
পর্যটক ফেদারসি। পর্যটক ফ্রান্সিস। ওঁদের দুজনের একই উদ্দেশ্য ছিল—লেখা নয়, সাহিত্য রচনা নয়; বরং বাণিজ্য করা, ধর্মযাকজতা করা, বাংলাদেশকে জানা। ওঁদের উদ্দেশ্য ওঁরা পুরো সফল করতে পারেননি। তবুও তাঁরা লিখেছেন। জানিয়েছেন তাঁদের আশাভঙ্গের কথা। স্বীকার করেছেন তাঁদের অপারগতা।
চট্টগ্রাম ছিল বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু—১৪০০ সাল থেকে ১৬৫০ সাল পর্যন্ত। সেই সময়ে বাংলার প্রথিতযশা কবিদের বেশির ভাগই এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। তাঁদের সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে চট্টগ্রামে। কবি জৈনিদ্দীন, গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহ’র সভাকবি। জন্ম ১৪৭৪ সালে চট্টগ্রামে। লিখেছেন ‘রসূল বিজয়’। কবি মজাম্মিল। তিনিও ওই সময়ের প্রতিবাদী কবি। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘সায়াত্ নামা’। নির্মল সংসার পরিচালনার জন্যে ওঁর উপদেশ স্বামী-স্ত্রীর কাছে। বাংলায় লেখা ইসলামের পথ ধরে। কেন বাংলায় লেখা? কবি নিজেই বলছেন, ‘আরবী ভাষায় পড়ে ন’বুঝে কারণ। সভানে বুঝিতে কৈলু পয়ার বচন।’ কবি আফজাল আলী এসেছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার মিহুয়া গ্রাম থেকে। আফজালও লিখলেন সমাজের জন্যে উপদেশাবলি—‘নসিহত্ নামা’। কবি শাহ বিরিদ খান। তিনিও চট্টগ্রামের। তিনিও লিখেন ‘রসূল বিজয়’। সঙ্গে আরো দুটো সুন্দর কাব্যগ্রন্থ; একটি ‘বিদ্যা সুন্দর’ ও অন্যটি ‘হানিফা ও কবরা পরী’।
বাংলার সমাজচিত্রের কিছুটা খুঁজে পাই শেখ ফয়জুল্লাহর লেখায়। তিনিও চট্টগ্রামের কবি। সেকালে শুঁটকি মাছের প্রচলন ছিল চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে। মাছপ্রিয় কবি পয়ারে লিখলেন, ‘টাঙ্গিয়া রৌদ্রতে দিল সুখনা মৈশ্চ যেন’। তাঁকে অনুসরণ করলেন চট্টগ্রামের আরেক নব্যকবি মুহম্মদ কবীর। বাংলার সমাজচিত্র না থাকলেও বাংলার মানুষের প্রেমের চিত্র রয়েছে তাঁর ‘মনোহর মধুমালতী’ কাব্যগ্রন্থে।
একের পর এক কবির জন্ম হতে থাকল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এলেন প্রতিবাদী কবি সৈয়দ সুলতান ১৫৫০ সালে। এলেন কবি শেখ পরান সীতাকুণ্ড অঞ্চল থেকে। এলেন কবি নসরুল্লাহ খান চট্টগ্রামের রামু অঞ্চল থেকে। এলেন কবি মুহম্মদ খান, ১৫৮০ সালে, চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে। লিখলেন ‘হানিফার লড়াই’ কাব্যগ্রন্থ। এলেন আরবি গবেষক ১৫৯৬ সালে সীতাকুণ্ড গ্রাম থেকে। লিখলেন ‘কিবায়তুল মুসল্লিন’। পরপর এলেন আরাকানি কবি দৌলত্ কাজী। এলেন ফতেহাবাদের সৈয়দ আলাওল হক। এলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী কবি মাগন ঠাকুর। বর্মি হরফে বাংলা সাহিত্যের প্রচার হয়েছে তাঁর লেখনিতে। লিপিবদ্ধ করলেন ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যগ্রন্থ। চট্টগ্রামের বাইরে সে-সময়ের দৃশ্যমান কবি হলেন দুজন। একজন হলেন কবি দোনা গাজী। তিনি এসেছেন চাঁদপুর অঞ্চল থেকে। অন্যজন কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর। তিনি কিংবদন্তির কথায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের কবি। ‘ইউসুফ জলিখা’ তাঁর রচনা।
তো এ আলোচনা করতে গিয়ে মনে প্রশ্নও জাগে।
প্রথম প্রশ্ন : ১৪০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ কবিই এসেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন : রাজনীতির হিসেবে সুবেদার ইসলাম খান চট্টগ্রাম অঞ্চল মোগল সাম্রাজ্যের অধিকারে এনেছে ১৬৬৬ সালে। মোগল শাসনের আওতায় আসার পর চট্টগ্রামে কোনো প্রতিভাবান কবি বিকশিত হয়নি। শুধু চট্টগ্রাম কেন? মোগল শাসনকালে সারা বাংলায় সাহিত্য বিকাশ কি রুদ্ধ হয়েছে? এ ব্যাপারে আধুনিক ইতিহাসবিদের কাছে আমরা কী আলো পেয়েছি?
বাঙালি মননে ইতিহাসপ্রিয়তা কদাচিত্ স্ফুটিত হয়েছে। লিপিবদ্ধ ইতিহাস থেকে আমরা কি শিখতে চেয়েছি? শত বছর আগে ব্রিটিশ প্রশাসক লর্ড ম্যাকেলে বাঙালি মননের উপর এক অপমানকর ভাষ্য রচনা করেছেন। সেই ভাষ্য সেই সময়ের বাঙালির উপর প্রযোজ্য ছিল। যদি আজকের বাঙালি মানদণ্ডে বিচার করি সেই ভাষ্য, তবে হয়তো দেখব আশ্চর্যজনক উদার লর্ড ম্যাকেলের সেই ভাষ্য। আজকের বাঙালির মনন মানদণ্ডে সে ভাষ্য অনেক উদার। অথচ লর্ড ম্যাকেলে উদারতার সঙ্গে উন্মুক্ত মন নিয়ে সে ভাষ্য লেখেননি। তিনি লিখেছেন তখনকার বাঙালিকে ছোট করার জন্য। আমরা পিছন ফিরে দেখতে চাই না। অতীত থেকে জানতে চাই না। অতীত নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমরা ধারণা করি আমাদের অতীত অতি দীন। সেই দৈন্যমনস্কতা আমাদের নিয়ত নিঃস্ব করে তুলছে। সত্যি কি আমরা আমাদের মননের মানদণ্ডে তীব্র দ্রুততায় অবনতির পথে এগিয়েছি?
এককালে বাঙালি উদার ছিল। বাঙালি দীপ্ত ছিল। বাঙালি উজ্জ্বল ছিল। প্রত্যেকটি সভ্যতার উজ্জ্বলতাকে সে ধারণ করেছে। বড় করেছে। বাংলাদেশে যেই এসেছে, আশ্রয় চেয়েছে, বাঙালি উদার মনে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। সে আফগান হোক বা তুর্কি হোক বা ফরাসি হোক বা আরমেনিয়ান হোক বা ওলন্দাজ হোক। ওরা এক এক করে এসেছে ইসফাহান থেকে। এসেছে আফগান দেশ থেকে। এসেছে পারস্য থেকে। এসেছে ইয়েমেন থেকে। সুধী সাধক যাঁরা এসেছিলেন সবাইকে দু’হাত তুলে অবারিত আন্তরিকতায় বাঙালি গ্রহণ করেছে। বাংলার দোর খুলে দিয়েছে। ওঁরা আস্তানা গেঁড়েছে। ওঁরা বিয়ে করেছে। ওঁরা ঘর-সংসার গড়েছে। বাঙালি ওঁদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে সমাজের সুন্দরতম প্রথাগুলো। সুন্দরতম সত্যের নীতিগুলো।
বাংলার খাদ্যে খোলা জানালার প্রভাব পড়েছে। মোরব্বা জ্যাম জেলি, পর্তুগিজ সভ্যতার কথা বলে। পেটিকোট, কামিজ, শেমিজ শব্দগুলো ফরাসি পরিধানের সৌন্দর্য ব্যঞ্জনা করে। শাড়ি, ব্লাউজ বহুদূরের রোমান নারীর পরিধানের কথা তুলে ধরে। নারীর অলংকার দক্ষিণ ভারতের প্রথার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে প্রভাব রয়েছে। ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতার ও সংস্কৃতির ছাপ আপন জীবনে গ্রহণ করে উঁচু শির নিয়ে আমরা এগিয়ে গেছি। আমরা উদার হয়েছি।
আজকে আমাদের পথ ছোট হয়ে এসেছে। পঙ্কিল হয়েছে আমাদের মনন। সংকীর্ণ হূদয়ে আমরা আমাদের উদার হাতগুলোকে ভাঁজ করে রেখেছি। রুদ্ধ করে রেখেছি সব দুয়ার। দরজার শেকল বুকের
কাছে ধরে আগলে রেখেছি। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবো না। কারো কিছু গ্রহণ করব না। কেন আমরা নিজেদের বঞ্চিত করে রাখছি উন্মুক্ত আকাশ থেকে? কেন উদার বিশ্বের জ্ঞানের স্বাধীনতা থেকে আমরা
ক্রমান্বয়ে আমাদের সরিয়ে আনছি। নিজেকে প্রশ্ন করেছিল পর্যটক ফেদারসি। পর্যটক ফার্নান্দেজ।
নিজেকে কি আমি প্রশ্ন করব না! উত্তরিত ইতিহাসের পথে এগিয়ে যেতে হলে!
লেখকঃ আব্দুর নুর, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক