তুষার আবদুল্লাহ,
আমরা যে এক অপরিচিত সময়ের মুখোমুখি, এই উপলব্ধি হচ্ছে না কারো। দল ও ব্যক্তিগত সংকীর্ণতা থেকে বেরোতে পারছি না। ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং প্রোপাগান্ডার মজাপুকুরে ডুবে আছি। মজাপুকুরে ডুবে থেকে কী করে জরা মুক্ত হবো? কোভিড-১৯ এর শুরু থেকেই দেখছি চিকিৎসা সেবা বিশেষ করে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নিয়ে ‘শাক’ তন্ত্র চলছে। প্রথমে বলা হচ্ছিল-করোনা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই সাধারণ ভাইরাস, বাংলাদেশে এসে সুবিধা করতে পারবে না। যখন প্রথম রোগী শনাক্ত হলো, তখন দাবি করা হয়- দু:শ্চিন্তার কারণ নেই। হাসপাতাল তৈরি আছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি এমন যে, করোনা চীন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সংক্রমণের সুযোগই পাবে না। তাই অবাধ যাতায়াত, সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। সন্তুষ্টির ঢেকুঁড় তোলা হয় করোনা পরীক্ষার গাণিতিক হিসেবে। কতিপয় চিকিৎসক কোভিড-১৯ দেখে লেজ গুটিয়ে পালালেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসকরাই পূর্বাভাস দিচ্ছিলেন— জ্যামিতিক ও সামাজিক সংক্রমণের। চিকিৎসকরা জীবন তুচ্ছ করে নেমে পড়েন মানুষের সেবায়। কিন্তু যারা মানুষের সেবায় ঝাঁপ দিলেন, তাদের নিয়েই চললো প্রশাসনিক ও পেশাগত রাজনীতি। তাদের এবং নার্সদের সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে বরখাস্তের নাটক মঞ্চস্থ করা হলো, সেবাদানকারী চিকিৎসক নার্সদের জন্য বিশ্রাম ও খাবারেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল জরুরি সেবা দিতে প্রস্তুত, এই ঘোষণা দেবার পরেও, হাসপাতালের দুয়ার থেকেই রোগীদের ফিরে আসতে হচ্ছে। এমনকি করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালও ফিরিয়ে দিচ্ছে রোগীদের। সোমবার রাতে চারজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফিরিয়ে দেয়। এই রোগীরা নিজেরা অ্যামম্বুলেন্স ভাড়া করে রওনা হন কুর্মিটোলা হাসপাতালের দিকে। করোনা রোগী বুঝতে পেরে তাদের ফেলে চলে যায় অ্যাম্বুলেন্স। এই রোগীরা রিকশায় করে যান কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। সেখানে একজনকে রেখে বাকি তিনজনকে বিদায় করে দেয়া হয়। তারা পথে পথে ঘুরতে থাকেন। এদের একজন আবার ছিলেন গর্ভবর্তী। পরে ‘করোনায় তারুণ্য’ তাদের রাত তিনটায় কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করতে সমর্থ্য হয়। কিন্তু ততক্ষণে ওই মানুষগুলো রিকশায় এবং পথে পথে যেখানে ঘুরেছে, সেখানে কোভিড-১৯ সংক্রমণের উৎস রেখে এসেছেন।
এখনও ঢোল বাদ্য বাজছে করোনা মোকাবিলার সামর্থ্যের। কিন্তু দলবাজির মোহ কাটিয়ে ওঠা চিকিৎসকরা কিন্তু চিৎকার করে বলেই যাচ্ছেন— ভালো নেই আমরা। আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সেই অনুপাতে অক্সিজেন, ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও নার্সের ঘাটতি আছে। পরীক্ষার পরিমাণ বাড়াতে হবে। নিয়ে যেতে হবে কমপক্ষে উপজেলা পর্যায়ে। কিন্তু সেই চিৎকার কানে তুলছেন না কর্তারা। দপ্তরগুলোর দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের দূরত্ব ক্রমশ বড় হচ্ছে।
লকডাউন প্রয়োজনের অনেক পরে শুরু হলেও, সাধারণ মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। দুটি কারণ এজন্য দায়ী। এক— মানুষ এখনও কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতাকে পাত্তা দিচ্ছে না। দুই— কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষজনকে খাবারের প্রয়োজনে পথে নামতে হচ্ছে। লগডাউন যতো দীর্ঘ হবে, পথে নেমে আসার তাড়না ততো বাড়বে। পুলিশ, জেলা প্রশাসন এবং বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণ বা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কতো দীর্ঘ সময় তা তাদের সাধ্যে কুলোবে? ব্যবসা–বাণিজ্যে যে মন্দাকাল শুরু হয়েছে, তাতে মানুষের আর্থিক সংকট আরো তীব্র হবে। বাজারে খাবার থাকলেও, তা কেনার সাধ্য থাকবে কতজনের এখন সেই হিসেব করার সময় এসেছে। সরকারের প্রণোদনা কতোটা নিচের স্তরের মানুষের কাছে নেমে আসবে তা নিয়েও সংশয় আছে। শিল্প মালিকেরা দেখছি গলা শুকিয়ে বসে আছেন। সরকারের প্রণোদনা জিভে তুলবেন বলে। ছোটো খাটো উদ্যোক্তার বাইরে আমাদের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যাংকের খেলাপি গ্রহীতারা যে পরিমাণ টাকা বাইরে রফতানি করেছেন তা ফিরিয়ে আনলে সরকারের কাঁধের ভার একটু হলেও হালকা হতো। কিন্তু তা না করে এখনও তারা লোভের জিভ বের করে রেখেছে প্রণোদনার জন্য।
কোভিড-১৯ এর মহামারিতে যদি এই লোভের জিভ কাটা না পড়ে, তবে ১৪২৭-এ গ্লানি মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না। তারপরও কোথা থেকে স্বপ্নলতা বেয়ে বেয়ে চলে আসে চোখের সীমানায়। আজ ভোরে শুনলাম কানাডার টরেন্টোতে বসে আমাদের এক সন্তান আবিদ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করেছেন। সংগ্রহ করা হচ্ছে চিকিৎসা ও খাদ্য সাহায্যের জন্য তহবিল। আমরা না পারলেও আবিদরাই হয়তো পৃথিবীর মানুষকে এক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। যার হোল্ডিং নম্বর—মানবিকতা।
তুষার আবদুল্লাহ, বার্তা প্রধান, সময় টিভি